জুয়েলারী জগতে আলোচনার কেদ্রবিন্দুতে “ডায়মন্ড সিটি” কেবিন ক্রূ/ ফ্লাইট স্টুয়ার্ড নেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স (ছেলেমেয়ে উভয়ই) বিনা অভিজ্ঞতায় “কেবিন ক্রু” পদে লোক নিবে নভো এয়ারলাইন্স, যোগ্যতা HSC, আবেদন করতে পারবে ছেলে মেয়ে উভয়ই। অচেনা নায়ক ! Unseen Hero !! কেবিন ক্রু নিয়োগ দেবে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ,যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক ,আবেদন করতে পারবে ছেলে মেয়ে উভয়ই বিনা অভিজ্ঞতায় “কেবিন ক্রু” পদে চাকরি, যোগ্যতা HSC পাশ, বেতন ৮০০০০ টাকা ইউএস-বাংলার বহরে নতুন বোয়িং যুক্ত ‘চাকরির হতাশায়’ ঢাবি গ্রাজুয়েটের আত্মহত্যা ! নতুন ৫ টিভি চ্যানেলের অনুমোদন , মিডিয়াতে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ জবস এওয়ানের এক যুগ পূর্তি
ঢাকা, মার্চ ২৮, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, স্থানীয় সময়: ০৩:১৩:৪৪

তসলিমা নাসরিন-এর ধারাবাহিক উপন্যাস শরম [দ্বিতীয় পর্ব]

| ৩১ শ্রাবণ ১৪২১ | Friday, August 15, 2014

Photo

আমার কোনও কিছু বিশ্বাস হতে চাইছে না। এই চেয়ারটায় সুরঞ্জন দত্ত বসেছে, বলেছে, মায়া বেঁচে আছে। অনেকক্ষণ ওভাবেই বসে থাকি আমি। মনে হতে থাকে রিয়ালিটির সঙ্গে ফিকশানের দেখা হল। গল্প লিখতে লিখতে যেভাবে সুরঞ্জনকে আমি কল্পনা করেছিলাম, তার মতো ঠিক নয় সে। তাকে দেখতে, তার কথা বলা, তার তাকানো, তার দৈর্ঘ প্রস্থের সঙ্গে আমার উপন্যাসের সুরঞ্জন মেলে না। সুরঞ্জন অস্বীকার করলেও আমার মনে হয় তার সঙ্গে আমার কোথাও দেখা হয়েছিল। আমার শান্তিবাগের বাড়িতে সে একবার নয়, দুবার গিয়েছিল। কেন তার সে কথা মনে নেই, তা আমার জানার কথা নয়। কার যে কী মনে থাকে, কী থাকে না, তা কি সে নিজেই জানে! আমরা নিজেরাই আমাদের অনেক কিছু ভুলে বসে থাকি, অন্যরা যারা আমাদের অনেক কিছু মনে রাখে, তার দায় কি অন্যরাই নেবে, নাকি আমরাও কিছু নেব। কেউ যদি আমাকে বলে বছর ষোলো আগে আমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল, আমরা একসঙ্গে কোনও এক; এখন বলো আমি পঁচিশ বছর আগে আসল সুরঞ্জনের চেয়ে তাকে দেখে আঁকা সুরঞ্জনের দিকেই আমি দীর্ঘ বছর তাকিয়েছি। আসল সুরঞ্জন ফিকে হয়ে গিয়ে ছবির সুরঞ্জনই আমার কাছে বেশি বাস্তব যেন। তার সঙ্গে দুবার দেখা হলেও আমি তো কল্পনা করে নিয়েছি অনেক কিছু। ঘটনাগুলো করিনি কিন্তু ঘটনার শাখা প্রশাখাগুলো তো করেছি। যেমন পুলকের কাছে যখন সে টাকা চায়, ওর বাড়িতেই প্রথম সে যায়নি, কাছের একটি দোকানের সামনে তার সঙ্গে দেখা করেছিল, তারপর দুজন মিলে বাড়িতে যায়। কিন্তু যেহেতু আমি পুলকের বাড়িতেই আগে সুরঞ্জনকে নিয়েছি, যেহেতু তাদের বাড়িতে যাবার আগে রাস্তায় দেখা করার সেই তথ্যটা তখন অর্থাৎ লেখার সময় আমার জানা ছিল না বলে যা জানা ছিল যতটুকু, তাই লিখে দিয়েছি বইয়ে। বইয়ে যা লিখেছি, তা লিখতে গিয়ে আমার বহুবার পড়া হয়েছে, ছাপা হওয়ার পরও বার বার পড়া হয়েছে। এই পড়ার কারণে আমার বেশি সত্য বলে মনে হয় বইয়ে যা লিখেছি তা, বাস্তবে যা ঘটেছে তার চেয়েও। কারণ বাস্তবের ঘটনা নিয়ে আমি চর্চা করিনি, চর্চা করেছি বইয়ের লেখা নিয়ে। তাতে হয় কী, বাস্তবে কী ঘটেছে তা অচর্চায় মলিন হয়ে যেতে থাকে। সুরঞ্জন আর পুলকের রাস্তায় দেখা হওয়াটা আমি জানি, জানলেও সেটা মলিন হতে থাকে, আর আমার মাথা থেকে বিস্মৃতি এসে ওকে উড়িয়ে নিয়ে যায় কোথাও।

মায়া, ভেবেছিলাম, মারা গেছে। কারণ লেকের জলে যে মেয়ে ভাসতে থাকে, তাকে কে ভাববে যে বেঁচে আছে? চোখের সামনে আমার দুটো মায়া, এক মায়া মৃত, লেকের জলে মরে পচে ফুলে ওঠা। আরেক মায়া কলকাতায়, জীবন্ত, ঝকঝকে। দুই মায়া আমাকে দেয়ালে ঠেসে ধরতে থাকে। সারাদিন আমি ঘোরের মধ্যে থাকি। কাউকে বলি না যে সুরঞ্জনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। ঘটনাটি শুধু আমার একার থাকে। কাউকে বলি না এই শহরের কোথাও মায়া নামের সেই মেয়েটি আছে, যে মেয়েটির বেঁচে থাকার কথা ছিল না কিন্তু বেঁচে আছে।

২.

সুরঞ্জন রাউডন স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে পার্ক সার্কাসের দিকে যাবে ভেবেও যায় না। পার্ক স্ট্রিটের দিকে যাবে না ভেবেও যায়, পার্ক স্ট্রিটের মেট্রো ধরবে ভেবেও ধরে না। প্ল্যানেটোরিয়াম পার হয়ে তাঁর একবার ইচ্ছে করে অ্যাকাডেমির দিকে যায়, ছবির প্রদর্শনী কিছু থাকলে দেখবে, নাহ, তারও ইচ্ছে হয় না, আনমনে হাঁটতে হাঁটতে সে ময়দানে পৌঁছোয় ঝাকড়া চুলওয়ালা একটি গাছের ছায়ায় এক শরীর ক্লান্তি নিয়ে বসে, গাছের পাতা একটু একটু নড়ছে, আলতো করে গায়ে আদর বুলিয়ে যায় হাওয়া। রোদে ভিজে পিঠে লেপ্টে থাকা সাটটি খুলে শুধু গেঞ্জি গায়ে শুয়ে পড়ে সটান ঘাসের ওপর। এ শহরে তাকে খুব বেশি কেউ চেনে না। জন্ম তো আর এ শহরে নয়। বড় হওয়া বেড়ে ওঠা কিছুই এ শহরে নয়। হাতে একটি সস্তার ঘড়ি, পকেটে তিরিশ টাকা। এই সম্পদ নিয়ে ঘুমিয়ে গেলে আশংকার কিছু নেই। চোরের পকেটও এর চেয়ে ভারি থাকে, হাতে এর চেয়েও ভালো ঘড়ি থাকে। নিজের হাতের ঘড়িটির দিকে অনেকদিন তাকাচ্ছে সুরঞ্জন, ঘড়ি পরার কোনও দরকার কি তার আছে? নিজেই জিজ্ঞেস করে, নিজেই উত্তর দেয়, নেই। সময় কেবল যায়, সময় কখনও আসে না। ঘড়িকে দিনে দুবেলা পুজো করলেও সেই ফেলে আসা দিনগুলোকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কেবল যে যাচ্ছে, এবং তাকেও নিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ একটা অন্ধকার খাদের দিকে, অনিশ্চয়তার দিকে, মৃত্যুর দিকে, তাকে অত ভালোবেসে জড়িয়ে রাখার কী আছে! কোনও একটা লেকের জলে, ভিক্টোরিয়ার জলে ঘড়িটাকে সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে ছুঁড়ে ফেলে দিতে।

ঘুমোতে চায় সে, কিন্তু পারে না। আজকের দিনটি তার জীবনের খুব স্মরণীয় দিন হতে পারতো, আজ কলকাতা শহরে সুরঞ্জন দত্ত, লজ্জার নায়ক, দেখা করেছে, তাকে নিয়ে উপন্যাস লিখে জগদ্বিখ্যাত হওয়া তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে। আজ কেউ জানলো না যে তাদের দেখা হয়েছে, উপচে পড়তে পারতো টেলিভিশনের লোকেরা, সংবাদ সংস্থা, আর সাংবাদিকে ভরে যেতে পারতো ঘর, যে ঘরটিতে আজ দুজন বসে কথা বলছিল। তার কি ইচ্ছে হয় অমন জমকালো কিছুর মধ্যে দাঁড়াতে। ভেতরে টের পায় সে, ইচ্ছে হয় না। জানে সে, খুব অপ্রতিভ লাগবে তার। তার চেয়ে এই ভালো, যেমন আছে সে। বাংলাদেশ থেকে চলে আসার পর প্রথম প্রথম তাকে নিয়ে হইচই হত। নিতান্তই পাড়ার মধ্যে ছিল সে হইচই। পাড়া ছাড়িয়ে ছিল সামান্য, ওর বেশি নয়। সাংবাদিকদের নজরে সে পড়েনি। সুধাময়ের মৃত্যুর সময় শুধু ছিল কিছু আলোর ঝলকানি। সুরঞ্জনের একটু ভালো লাগেনি ক্যামেরার চোখ জ্বালা করা সেইসব আলো। সাংবাদিকদের পাথর পাথর মুখ।

লজ্জা নিয়ে একশো রকম লেখালেখি তখন খবরের কাগজে। কলকাতা থেকে সোনারপুরে যেতে আসতে সুরঞ্জন দেখতো ট্রেনে প্রতিদিনই লজ্জা বিক্রি হচ্ছে। লজ্জা লজ্জা বলতে বলতে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে হকারগুলো। তখন সবে এসেছে তারা কলকাতায়। বেলঘরিয়ায় এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিল। সোনারপুরে প্রায়ই তাকে যেতে হত তখন। দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় তাকে কথা দিয়েছিল কোথাও একটি চাকরির ব্যবস্থা করবে। না হলে ওয়াগন তৈরির কারখানায় ঢুকিয়ে দেবে। সুরঞ্জন অনেকদিন সেই আশায় ঘুরেছে। সেই সব দিন যেন এই সেদিনের ঘটনা। দিন যে কী করে চলে যায় চোখের পলকে! মাত্র কটা বছরেই জীবন কী ভীষণ পাল্টে গেল। সে যে লজ্জার সুরঞ্জন এই কথা বলতে গিয়ে বেশ কয়েকটি জায়গায় মার খেয়েছে সে, নয়তো বিদ্রুপ শুনেছে। কেউ তাকে বিশ্বাস করেনি। এরপর বলাই সে বন্ধ করে দিয়েছে সে সুরঞ্জন। অনেকে নাম শুনে ভাষায় বাঙাল টান শুনে চোখ কুঁচকেছে, বলেছে-তোমরা তো বাবরি মসজিদের ঘটনার পর বাংলাদেশ থেকে এসেছো। তুমি কি তাহলে লজ্জা বইয়ের সুরঞ্জন নাকি? সুরঞ্জন সজোরে মাথা নেড়ে না বলেছে। স্বীকার করলে আবার কী থেকে কী হয়ে যায় কে জানে। বিপদ থেকে সে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চেয়েছে। বিপদ কম আসেনি। মুখে ঘুষি খেয়ে চোখের তলায় কালসিটে দাগ পড়েছিল পুরো দুমাস। বিশ্বাস করেনি অনেকে, কিন্তু আবার কয়েকটি জায়গায় তাকে কী কারণে সে জানে না যে বিশ্বাসও করেছে। তাকে স্থানীয় মঞ্চে তুলেছে, সম্বর্ধনা দিয়েছে, এমনকি চাকরিও পাইয়ে দিয়েছে। কিন্তু রাজ্য জুড়ে বেলঘরিয়ার প্রফুল্ল নগরে দূর আত্মীয়ের বাড়ির একটি ঘরে বাবা মা আর বোনকে নিয়ে কোনওভাবে মাথা গুঁজে পড়ে থাকা সুরঞ্জন যে লজ্জার সুরঞ্জন তা রাষ্ট্র হয়নি। রাষ্ট্র হলে কী ইবা হত, এদিক-ওদিকে একটু সুবিধা পেত হয়তো। কীইবা সেসব সুবিধা আর! চোখ বোজে সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের ভেতর আকাশের মতো নীল যন্ত্রণা সুঁইয়ের মতো ঢুকে যায়।    Photo

দুপুরে সে বাড়ি ফেরে। খায়। ঘুমোয়। বিকেলে দুটো বালক আসে পড়তে, সন্ধেয় দুটো বালিকা। সপ্তাহে দুবার সে যায় দুবাড়িতে। একেকদিন একেকজনকে পড়ানো। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে কথাটা ঠিক নয়। সুরঞ্জনই তার প্রমাণ। তার টিউশনির টাকা দিয়ে সংসার চলে না। কিরণময়ী শাড়ি বিক্রি করতে শুরু করায় তবু কিছুটা রক্ষে। ঘরেই শাড়িতে অ্যাম্ব্রয়ডারির কাজ করিয়ে বিক্রি করেন কিরণময়ী। খুব বেশিদিন এ কাজ করছেন না। শাড়ি বিক্রি করে এমন এক মহিলার সঙ্গে বন্ধুত্ব হল তাঁর আর তারই উৎসাহে এই ব্যবসায় নামা। অভাবের সংসারের হাল তিনি নিজেও কিছুটা ধরতে পারবেন বলে শুরু করা। তিনি হাল ভালোই ধরেছেন, আবার আগের মতোই রেঁধে বেড়ে ছেলেকে খাওয়ান। ছেলে বাড়ি ফিরবে কখন, অপেক্ষায় বসে থাকেন।

সুরঞ্জনের খেতে খেতেই তার মাকে বলেছে,-আজ সকালে তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে দেখা হল।

কিরণময়ী হাঁ হয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। উত্তেজনায় কথা বলতে পারছেন না। জল খেয়ে ঢোক গিলে গিলে মাথা শান্ত করে বললেন, -কী করে গেলি। কোথায় থাকে জানলি কি করে? কী বললো তোকে? আমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করলো? থাকতে চাইছে তো ও। ওকে কি থাকতে দেবে সরকার?এত কথার উত্তর সুরঞ্জন দেয় না। শুধু বলে,-মায়া যে বেঁচে আছে, জানে না। একটু চমকে উঠলো মায়ার কথা বলাতে।-হতেই পারে। পরে বোধহয় আর খোঁজ নেয়নি। আর দেশেই তো ছিল না। বেরিয়ে যেতে হল। বেচারা। কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। অনেকক্ষণ দুজনের মুখে কথা নেই। পুঁইশাক, পোনা মাছ আর ডাল দিয়ে সুরঞ্জন খাওয়া শেষ করে। মুশরির ডালটা চুমুক দিয়ে শেষে খায়। এ পাড়ায় সবাই ডাল আগে খায়। এ বাড়িতে দেশের অভ্যেসই চলে। ডালটা শেষে খেলে জিভে পাঁচ ফোড়নের অপূর্ব স্বাদ লেগে থাকে।

সোনার চামচ মুখে নিয়ে সে জন্মায়নি। সাধারণ এক মধ্যবিত্ত ঘরে তার জন্ম। দারিদ্র্যের কথা সে শুনেছে, দারিদ্র্য সে দেখেছে, কিন্তু নিজেকে ভোগ করতে হয়নি কোনওদিন। কিন্তু দেশ ছাড়ার পর হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল দারিদ্র্যের বত্রিশ দাঁতের কামড়। প্রফুল্ল নগরে যাদের বাড়িতে উঠেছিল, সম্পর্কে কিরণময়ীর দূরসম্পর্কের দাদা। কথা ছিল, যতদিন না ভাড়ার জন্য ভালো জায়গায় বাস করার মতো একটা বাসা পাওয়া যায়, ততদিন ওই আত্মীয়ের বাড়িতে পুরো পরিবারই থাকবে। এর মধ্যেই সুধাময় ডাক্তারি শুরু করবেন, সুরঞ্জন চাকরি খুঁজে নেবে, মায়া আপাতত টিউশনি করবে, পরে ভালো কোনও চাকরি। আশ্রয় দিল বটে দূর সম্পর্কের দাদা কিন্তু সেই দেওয়ায় ভ্রুকুঞ্চণ ছিল। সারাক্ষণই উঠতে বসতে শোনাতে লাগলো নিজেদের প্রচণ্ড অভাবের গল্প। উঠোনে দশ বাই দশ ফুটের একটি ঘর জুটলো সবার জন্য। রান্না আলাদা, উঠোনে খড়ির চুলোয়। শংকর ঘোষের রান্নাঘরে মাছ মাংস রান্না হয়, আর আশ্রিত পরিবারটির জন্য জোটে রুটি ডাল আর আলুর তরকারি। সুধাময় যে আÍসম্মান বজায় রাখার জন্য দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটি, সেই বাড়িতে ঢুকে টুকরো টুকরো হয়ে প্রতিদিন ভাঙতে লাগলো। ভাঙলেও তিনি ভেঙে পড়তে চাইতেন না। শংকর ঘোষের একচিলতে বারান্দায় ছোট একটি টেবিল আর একটি মোড়া পেতে রোগী দেখা শুরু করলেন। বাংলাদেশ থেকে এসে চেম্বার খুলে বসেছেন, কেউ ঠিক বিশ্বাস করতো না সুধাময় কোনও ভালো ডাক্তার, অথবা আদৌ কোনও ডাক্তার। এ দেশি ওষুধের নাম তো সুধাময়ের জানা নেই। ওষুধের নাম না লিখে বরং ওষুধের গোত্রের নাম লিখে দিয়ে বলতেন, ফার্মেসিতে নিয়ে বলবেন এই গোত্রের কোনও একটা ওষুধ দিতে। রোগীরা গোত্র বুঝতে চাইতো না। ডাক্তার হলে ওষুধের নাম কেন জানে না, এ ছিল তাদের ভ্যালিড কোয়েশ্চান। কটা আর রোগী আসতো তার কাছে! সারাদিন বসে থেকে পাঁচ ছটা রোগী, পাঁচ ছ টাকা দিত ডাক্তারের ফি। আত্মীয়ের হাতে দিয়ে দিতে হয় যা জোটে। থাকা খাওয়ার খরচ।

সুধাময়ের হাতে কোনও টাকা নেই। দেশ ছেড়ে আসার সময় পথে আবার টাকা পয়সা থাকলে কে না কে লুট করে নিয়ে যায়, সেই ভয়ে হাতে সামান্য কিছু নিয়েছিলেন পথের খরচ। আলাদা একটা বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছেন তিনি কিন্তু নতুন নগরে ডাক্তারির উপার্জনে ছোট কোনও বাসাও যে ভাড়া নেওয়ার জন্য তাঁর জুটবে না, টের পেতেন। হাতে টাকা ছিল না বলে ডাক্তারির ওপরই তাঁকে নির্ভর হতে হত। কিন্তু টাকা কেন সুধাময়ের হাতে ছিল না! দেশ ছাড়ার আগে চার লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়ে তার কী লাভ হল! অত টাকা সঙ্গে করে নেওয়া যাবে না। ব্যাংকের মাধ্যমেও সম্ভব নয়। লোকে বুদ্ধি দিল, হুন্ডি কর। হুন্ডি কারা করে কী করে করে সুধাময়ের জানা ছিল না। শংকর ঘোষের সঙ্গে কলকাতা যাওয়া নিয়ে ফোনে কথা হচ্ছে। সে-ই উপদেশ দিল, নারায়ণগঞ্জের গৌতম সাহা কলকাতায় আসছে যাচ্ছে, কাপড় চোপড়ের ব্যবসা আছে কলকাতায়, তাকে চার লাখ টাকা দিয়ে দিলে কলকাতায় সুধাময়রা পৌনে চার লাখ টাকার মতো পেয়ে যাবেন। নারায়ণগঞ্জের সেই ব্যবসায়ীর খোঁজ করে তাকে নিজের হাতে চার লাখ টাকা দিয়েছিলেন তিনি, শংকর ঘোষের প্রতিশ্র“তির ওপর ভরসা করে সুধাময় জমানো টাকাগুলো দিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু শংকর ঘোষ তার কথা রাখেনি। কলকাতায় এসে হুন্ডির টাকা ফেরত চাইলে বললো টাকা তো আর সে দেবে না, দেবে প্রতাপ মণ্ডল, তার ব্যবসা আছে বাংলাদেশে, কিন্তু সে এখন ভোপালে, ভোপাল থেকে ফিরবে শিগগিরি। সেই শিগগিরির অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে শ্বাসকষ্ট হতে থাকে সুধাময়ের। কিরণময়ী তার মামাতো ভাইয়ের ভায়রা ভাইয়ের ভাই শংকর ঘোষের কাছে টাকার কথা পাড়ে। টাকাগুলো হাতে পেলে নিজেরাই তারা একটা বাসা ভাড়া করে উঠে যেতে পারে, এখানে থেকে নিজের এবং অন্যের অসুবিধের কারণ হতে হয় না। নরম সুরে, বিরক্ত স্বরে নানা সুরে স্বরে বলে দেখেছে, শংকর ঘোষ আজ ভোপাল দেখায়, কাল বোম্বে দেখায়। প্রতিশ্র“তি অচিরেই সুধাময় বোঝে যে মিথ্যে ছিল। এই বিদেশ বিভুঁইএর কী করতে পারে সে এর বিরুদ্ধে। সুধাময়ের সেই লতায় পাতায় মানিকগঞ্জের আত্মীয় ননীগোপাল দমদমে থাকে। তার কাছেও হাত পেতেছেন সুধাময়, ধার চেয়েছেন, না টাকা জোটেনি।পাগলের মতো একটা চাকরি খুঁজছে তখন সুরঞ্জন। চিনা মাটির ফ্যাক্টরিতে খোঁজে। টেক্সম্যাকোতে খোঁজে। বেলঘরিয়া ইস্কুলগুলোয় মাস্টারির চাকরি খোঁজে। পায় না। এমন অসহায় সে কখনও কোনওদিন বোধ করেনি। গলা পর্যন্ত বাংলা মদ গিলে এসে সে এক রাতে শংকর ঘোষের কলার টেনে উঠিয়ে চোয়ালে কষে ঘুষি মেরে বলেছে,-টাকা ঠিক ঠিক মতো দিয়ে দে হারামজাদা, নইলে তোকে আমি খুন করবো আজকে। খুন করা সুরঞ্জনের হয়ে ওঠেনি। কাউকেই খুন করা সুরঞ্জনের হয়ে ওঠে না। হাত যে তার নিশপিশ করে না তা নয়।

যখন জীবন অসহ্য রকম দুঃসহ, তখন হই হই করে লজ্জা বিক্রি হচ্ছে। সুরঞ্জন বলা বন্ধ করে দিলেও সুধাময় লোক ডেকে ডেকে বলতেন, লজ্জায় তো আমাদের পরিবারের কথা লেখা হয়েছে। কেউ কপালে ওঠাতো চোখ। কেউ তীক্ষœ চোখে তাকিয়ে অভিসন্ধি খুঁজতো, কেউ হাসতো, কেউ বিশ্বাস করতো, আহা উহু করতো। বিশ্বাস করার লোক বরাবরই খুব কম ছিল। যারা বিশ্বাস করতো, তাদের দিয়ে খুব একটা কিছু লাভ হয়নি কারওর। বেলঘরিয়ার লোকেরা এসে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো সুধাময়ের দিকে। সুধাময় ডানে ফিরলে তারাও ডানে ফেরে, বামে ফিরলে তারাও বামে। যেন তিনি একটি দ্বিপদী জীব এসেছেন চিড়িয়াখানায়। চিড়িয়াখানায় আসা নতুন কোনও জন্তুর দিকে লোকে যেমন দেখে, ঠিক তেমন করেই তাঁকে দেখে। এতে রোগী যে দু’একটা বাড়বে তা নয়, রোগী আরও কমে গেল। [চলবে]

প্রথম পর্বের লিংক : ▬>>sangbadkantha.com/180 

█ সংবাদ কন্ঠের ফেইসবুক ফ্যান পেইজের এড্রেস : Facebook.com/MySangbad

[ ঘোষণা : নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন-এর উপন্যাস শরমধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে প্রতি শুক্রবারবাংলাদেশ প্রতিদিন‘-এর সৌজন্যে তা তুলে ধরা হবে সংবাদ কন্ঠ -এর পাঠকদের জন্য