জুয়েলারী জগতে আলোচনার কেদ্রবিন্দুতে “ডায়মন্ড সিটি” কেবিন ক্রূ/ ফ্লাইট স্টুয়ার্ড নেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স (ছেলেমেয়ে উভয়ই) বিনা অভিজ্ঞতায় “কেবিন ক্রু” পদে লোক নিবে নভো এয়ারলাইন্স, যোগ্যতা HSC, আবেদন করতে পারবে ছেলে মেয়ে উভয়ই। অচেনা নায়ক ! Unseen Hero !! কেবিন ক্রু নিয়োগ দেবে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ,যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক ,আবেদন করতে পারবে ছেলে মেয়ে উভয়ই বিনা অভিজ্ঞতায় “কেবিন ক্রু” পদে চাকরি, যোগ্যতা HSC পাশ, বেতন ৮০০০০ টাকা ইউএস-বাংলার বহরে নতুন বোয়িং যুক্ত ‘চাকরির হতাশায়’ ঢাবি গ্রাজুয়েটের আত্মহত্যা ! নতুন ৫ টিভি চ্যানেলের অনুমোদন , মিডিয়াতে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ জবস এওয়ানের এক যুগ পূর্তি
ঢাকা, মে ৫, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ০৩:২১:২৭

চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলীর মরণদশা, দূষণ-দখলে বিপন্ন

| ৮ শ্রাবণ ১৪২১ | Wednesday, July 23, 2014

1.jpg

চট্টগ্রাম বন্দর সমগ্র জাতীয় অর্থনীতির হৃদপিন্ড  আর দেশের এই প্রধান সমুদ্র বন্দরেরই শুধু নয়; বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রাণভোমরা হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। কিন্তু সেই খরস্রোতা পাহাড়ি নদী কর্ণফুলী এখন মোটেই আর আগের ‘সুস্থ’ অবস্থায় নেই। চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদীর চলছে চরম মরণদশা। বেপরোয়া দখল-বেদখল, দূষণ ও ভরাটে বিপন্ন হয়ে উঠেছে কর্ণফুলী নদী, একই সাথে চট্টগ্রাম বন্দর। সাড়ে ৫শ’ ছোট-বড় শিল্প-কারখানা, প্লান্ট, দেশি-বিদেশি জাহাজ কোস্টার নৌযান ট্রলারের বিষাক্ত বর্জ্য-ময়লা-জঞ্জাল ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে কর্ণফুলী নদী, নৌ-চলাচলের মূল (নেভিগেশনাল) চ্যানেল, বহির্নোঙ্গরসহ বন্দর এলাকা। ক্রমেই বিষিয়ে উঠেছে পানি। নদীর পানির স্বাভাবিক রঙ, গন্ধ ও স্বাদ আর নেই।

৫০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত চট্টগ্রাম নগরীর বিশাল অংশের নগর বর্জ্যরে প্রধান ঠিকানা কর্ণফুলী। বিলুপ্ত হচ্ছে এ নদীর হাজারো জীববৈচিত্র্য। এককালে হরেক প্রজাতির চিংড়িসহ সুস্বাদু মাছের খনি কর্ণফুলী নদী এখন প্রায় বলতে গেলে মাছশূন্য জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, কর্ণফুলী নদীতে মিঠা পানির ৬৬ প্রজাতির, মিশ্র পানির ৫৯ প্রজাতির এবং সামুদ্রিক পরিযায়ী ১৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো। দূষণের কবলে পড়ে এরমধ্যে মিঠা পানির প্রায় ২৫ প্রজাতির এবং মিশ্রপানির ১০ প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্তপ্রায়। এছাড়া আরও ১০ থেকে ২০ প্রজাতির অর্থকরী মাছ বিপন্ন।  বন্দর চ্যানেল ঘেঁষে কর্ণফুলী মোহনায় প্রায় ১৫৮ একর ভূমি বেদখল হয়ে গেছে। গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা।

কর্ণফুলীর উভয় তীরের অবৈধ দখল হওয়া জমি উদ্ধার করে অচিরেই সরকারের আয়ত্তে আনার দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা ব্যক্ত করেন এবং এ ব্যাপারে যে যত প্রভাবশালীই হোক কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। তাছাড়া অনুরূপ কঠোর সিদ্ধান্তের কথা বলেছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মেসবাহউদ্দিন। বেদখলকৃত জমি-জমা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা, স্থগিতাদেশও ঝুলে আছে। থমকে গেছে ভূমি বেদখল মুক্ত করতে মোবাইল কোর্টের অভিযান। কর্ণফুলী নদীর উভয় পাড়কে কেন্দ্র করে চলছে ভরাট ও দখলের প্রতিযোগিতা। সম্প্রতি জেলা প্রশাসন কর্ণফুলী নদী তীরবর্তী ১৫৮ দশমিক ৪৫ একর ভূমিতে অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে। এ জমির আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৩শ’ ৪০ কোটি টাকা।

আবার সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনের দাপট দেখিয়েও যথেচ্ছভাবে রাতারাতি সারি সারি বাড়ি-ঘর বানিয়ে কর্ণফুলীর তীরভূমি বেদখল করা হয়েছে। এর পেছনে তৎপর রয়েছে একেকটি ভূমিদস্যু চক্র। কথিত সমিতির নামে প্লট বেচাকেনা চলছে। প্লটের ব্যবসায় অপরিকল্পিত বালি তোলার কারণে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চাক্তাই রাজাখালীর দু’পাশে, চর পাথরঘাটা, সিডিএ মাঠ, ওমরআলী ঘাট, মনোহরখালী এলাকার কাছেও কেউ কেউ নতুন চরের জমির দাবিদার সেজে, আবার কেউ নদীর বালি তুলে ডুবোচর ভরাট করে কর্ণফুলী দখলে মেতে উঠেছে। এ নিয়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, নিত্যনতুন অপরাধমূলক কর্মকা- মাথাচাড়া দিয়েছে।

কর্ণফুলী নদীর বর্তমান চরম মরণদশায় চট্টগ্রামের সকল পর্যায়ের নাগরিক সমাজ সম্প্রতি আবার নতুন করে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। ‘কর্ণফুলী কি বুড়িগঙ্গায় পরিণত হবে?’ এই শিরোনামে একাধিক সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। কর্ণফুলীকে বাঁচাতে সাম্পান র্যালি, সাম্পান খেলা ও মেলা হয়েছে সম্প্রতি। টনক নড়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরেরও। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সংগঠন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন-সমিতির পর্যায়ে আন্দোলন ধীরে ধীরে দানা বেঁধে উঠলেও প্রধান দু’টি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি’র চট্টগ্রামের রথি-মহারথীরা কর্ণফুলীকে বাঁচানোর প্রশ্নে কার্যত নীরব-নির্বিকার দর্শকের ভূমিকাই পালন করছেন। এ নিয়ে সচেতন নাগরিকমহলে সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠেছে- কর্ণফুলী যদি না বাঁচে চট্টগ্রাম কি বাঁচবে? চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতারা তাও কি বোঝেন না? নাকি না বোঝার ভান করে আছেন! সামাজিক সংগঠনসমূহ কর্ণফুলী সুরক্ষায় অচিরেই সরকারের সুনির্দিষ্ট, কঠিন ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ বিশেষ করে তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

সুদূর অতীতকালে সেই কানফুলের দুঃখগাঁথা জড়িয়ে নদীটির নাম হয় কর্ণফুলী। নদী আজও বহমান, কিন্তু কর্ণফুলী এখন তেমন খরস্রোতা নয়। বেপরোয়া দখল-বেদখল, দূষণ আর পলি-বালি ও জঞ্জালে ভরাট হয়ে বিপন্ন হয়ে উঠেছে নদীর বুক। অথচ কর্ণফুলী নিছক একটি নদীর নাম নয়; বরং দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য প্রাণস্পন্দন, স্নায়ুস্বরূপ। কর্ণফুলী আর বঙ্গোপসাগরের মিলিত মোহনায় গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম। আর তাকে ঘিরে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ।

এছাড়া দূষণের কারনে কর্ণফুলী নদীর পানিতে অক্সিজেন হ্রাস পায়। অক্সিজেন কমে পানির বিওডির মাত্রা ০.৭ থেকে ৩.৮ পিপিএম-এ দাড়িয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে পানির বিওডির সহনীয় মাত্রা হচ্ছে সর্বনিম্ম ৫ পিপিএম। চট্টগ্রাম কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী বাহাদুর শাহ জানান, কর্ণফুলী নদীর পানিতে ক্ষার বেড়ে যাওয়ায় পিএইচ (পানির আদর্শ মান) হ্রাস পেয়েছে। অক্সিজেন কমে গিয়ে পানির রং ও গুণাগুণ নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি দুর্গন্ধযুক্ত। এ পানি খেলে পেটে অসুখ হবেই।

কর্ণফুলীর নাব্যতা হ্রাস কেপিএমসহ অন্যান্য কলকারখানার বর্জ্য ও ইঞ্জিত চালিত নৌকা থেকে নির্গত তেলে কর্ণফুলী নদীর পানির ওজন বেড়ে গেছে। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর নাব্যতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিভিন্ন অংশে ফেরি ও নৌ চলাচল মারাত্বকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রাঙ্গুনিয়া ইছাখালি ঘাটের মাঝি রফিুকুল ইসলাম জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদিত ফল ও ফসলের স্বল্প ব্যয় ও নিরাপদ পরিবহনে কর্ণফুলী নদীপথ ছিল ব্যবসায়ী মহলের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।

কর্ণফুলী কাগজ কল, কর্ণফুলী পাটকল, ফোরাত কার্পেট কল, সিরামিক কারখানা ও রাউজান তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ নদী তীরবর্তি শিল্প প্রতিষ্ঠান সমুহের উৎপাদিত পণ্য, কাঁচামাল এবং বিভিন্ন মেশিনারী সামগ্রী আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে কর্ণফুলী নদীপথ সর্বাগ্রে গুরুত্ব পেত। নদীর বুকে বাঁশ-কাঠের চালি ভাসিয়ে গন্তব্যে পাড়ি দেয়াসহ নৌ-বহরের চালানে ব্যবসায়ী মহল লাভবান হত। কিন্তু কর্ণফুলীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় ব্যবসা, বাণিজ্যসহ ভারী জিনিসপত্র পরিবহণে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, কাপ্তাই থেকে বন্দর পর্যন্ত নদীর মাঝখানে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জেগে ওঠা অসংখ্য চর নদীর নাব্যতাকে বিলীন করেছে।

ভাটার সময় নদীতে চলাচলরত বাঁশ গাছের চালি এবং বিভিন্ন প্রকারের নৌ-যান চরে আটকে যায়। দুর্ভোগে পড়তে হয় খেয়া পারাপাররত সাধারণ মানুষ এবং পণ্যবাহি নৌ-যানগুলোকে। জোয়ার-ভাটার সময় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নৌযানগুলোকে কর্ণফুলী নদীপথে চলাচল করতে হয়। কৃষির ভরা মৌসুমে ভাটার সময় সেচ প্রকল্পগুলো অচল হয়ে পড়ে। নদীর বিভিন্নস্থানে এলোমেলো চর জেগে উঠার কারণে নদীর পানি প্রবাহ পরিবর্তনে তীরের দু’দিকে ভাঙন বেড়ে গেছে। নদী সংস্কার এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার অভাবে দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত ভাঙনে রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটার ভূমিরখীল গ্রাম, পশ্চিম সরফভাটা এবং শিলকের বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। খনন করে কর্ণফুলী নদীর মাঝপথে স্বাভাবিক প্রবাহ সৃষ্টি করা না হলে কর্ণফুলীর অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।

কর্ণফুলী নদী গবেষক অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া এবং অধ্যাপক ইউনূস হাসান বলেছেন, দেশের অপর কোন নদ-নদীর তুলনায় কর্ণফুলী নদীর রয়েছে আলাদা কিছু ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও অবস্থান। এগুলো ঠিক রেখে কর্ণফুলী রক্ষার জন্য নদীর তীররেখা চিহ্নিত করা এবং তীর বাঁধানো এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কর্ণফুলী বাঁচলেই বন্দর বাঁচবে। এর উভয় তীরের নগরায়নের ধারা, ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও হাজার বছর ধরে মানবসভ্যতা বিকশিত হয়েছে। মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। কাপ্তাইয়ে রয়েছে পানিবিদ্যুৎ মহাপ্রকল্প। নদীটির দুই তীরজুড়ে ৭৫ লাখ মানুষের বাস। বিস্তার লাভ করেছে বিশাল সওদাগরী পাড়া। সভ্যতার মেলা।

প্রকৃতির অপার দান কর্ণফুলী। এ নদীটি মানুষকে সবই দিয়েছে উদারভাবে। কিন্তু সেই নদী দিন দিন ভরা যৌবন হারিয়ে ফেলছে।

প্রভাবশালী চক্রের দাপটে ভূমিদস্যুরা গ্রাস করে নিচ্ছে নদী তীরের সরকারি জমি, পলি ভূমি, সদ্য জেগে ওঠা চর, তলদেশের বালি-মাটি। চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৪টি খাল দিয়ে আবর্জনা নিষ্কাশন, দু’শ’ কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও শত শত জাহাজের তেলবর্জ্য নিঃসরণের কারণে কর্ণফুলী পরিণত হয়েছে অঘোষিত এক ভাগাড়ে। বিষিয়ে উঠছে নদীর পানি। বাড়ছে লবণাক্ততার মাত্রা। মূল্যবান চিংড়িসহ অর্ধশত প্রজাতিরও বেশি অর্থকরি মাছ নদী থেকে ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে।

এহেন নাজুক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দু’বছর আগেই হাইকোর্ট কর্তৃক জাতীয় অর্থনীতির প্রাণভোমরা কর্ণফুলী নদী সুরক্ষায় কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়। নদীজুড়ে দখল, মাটি ভরাট ও যেকোন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ রাখার জন্য সরকারের প্রতি এবং কর্ণফুলী নদীর প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দাখিল করতে জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়া ছাড়াও কর্ণফুলী সুরক্ষা সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল।

এদিকে কর্ণফুলী নদীর বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বন্দরের লাইটারেজ জেটির ঘাট ও জায়গাগুলো প্রতিনিয়ত নদীর বুকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নাব্যতা ও গতিপথ রক্ষায় নদীশাসন, নিয়মিত ড্রেজিং ও দূষণরোধ জরুরি হলেও দীর্ঘদিন ধরে তা উপেক্ষা করা হচ্ছে। বরং জমির দাম বাড়ার সাথে সাথে চলছে ভরাট ও দখলের প্রতিযোগিতা। চওড়ায় ও গভীরতায় নদীটি ছোট হয়ে আসছে। পানি প্রবাহ ও ধারণক্ষমতা হারিয়ে বর্ষায় কাদা-পানির জোয়ারে ডুবে যাচ্ছে বন্দরনগরী এবং এর ব্যবসা ও শিল্পাঞ্চল। এককালে বন্দরের কর্মব্যস্ত বন্দর এলাকা ওমর আলী ঘাট, অভয়মিত্র ঘাটে, মনোহরখালী মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও এ পাশে চর জেগে নদী ভরাট ও মরা বন্দরে রূপ নিয়ে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। জাপানি সহায়তায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৭ বছর আগে নির্মিত মনোহরখালী মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে এখন আর মাছের ট্রলার-নৌকা ভিড়তে পারে না। বন্দরের মূল ১নং জেটি অতিক্রম করে ক্রমেই পলিবালির আস্তর জমেছে।

চট্টগ্রাম মহানগরীকে অর্ধচন্দ্র আকারে বেষ্টন করে রেখেছে কর্ণফুলী নদী। তীরজুড়ে বিস্তীর্ণ ভূ-সম্পত্তির মালিক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বিগত সময়ে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে কঠোর সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি উদ্ধারে যে সাফল্য আসে, তারও কিছু কিছু ফের বেদখল হয়ে গেছে। বন্দরের মূল্যবান জমি ইজারার আড়ালে হাতছাড়া করা হয়েছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে। নেপথ্যে বিপুল অংকের অর্থ অবৈধ লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে। জোয়ারে প্লাবিত ভূমি থেকে ৫০ গজ দূর পর্যন্ত পোর্ট লিমিট হিসেবে গণ্য করা হয়। সেখানে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন স্থাপনা নির্মাণ বেআইনি। কিন্তু গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। নদীর গতিপথ বদল ও নদী ভাঙনের সাথে মিল রেখে সঠিক ও নিয়মিতভাবে তীরভূমি রেখা কোথাও চিহ্নিত করা হয়নি। এর পুরো সুযোগ নিচ্ছে ভূমিগ্রাসী চক্র। আবার অনেকে অনুমোদনের আড়ালে জায়গা বাড়িয়ে অবৈধ কাঠামো বানাচ্ছে। যা কর্ণফুলী নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে।

কর্ণফুলীর তলদেশ থেকে বালু ও মাটি তুলে নদীতীর ভরাট করে প্রকাশ্যে অবৈধ প্লট ব্যবসা এমনকি ইটের ভাটা চলছে দীর্ঘদিন। সম্প্রতি ভূমি প্রতিমন্ত্রীর স্পট নির্দেশে বন্দরের লাগোয়া কর্ণফুলীর মাটি দিয়ে অবৈধ ইটের ভাটা বন্ধ করা হয়।

কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল তথা পাহাড়ি অববাহিকার একটি প্রধান নদী।
আসামের লুসাই পাহাড় থেকে ২৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর উৎপত্তি। ভারতে এর বিস্তৃতি খুবই কম। এ নদীর মোহনাতে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর সুবিধা গড়ে উঠেছে। পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক শাহরিয়ার খালেদ জানান, দখল, ভরাট ও দূষণের কারণে কর্ণফুলী পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘ গতিপথের কর্ণফুলী নদীর কাপ্তাই বাঁধের উজানে উপনদী রয়েছে ৫টি, ভাটিতে ২টি।

এরমধ্যে এক সময়ের খরস্রোতা ইছামতি নদ মরে গেছে। কর্ণফুলীর দু’তীরে ভাঙনে নদী আকার আয়তনে হ্রাস-বৃদ্ধি পায় বিভিন্ন সময়ে। চাক্তাই পয়েন্টে ১৯২৬ সালে ১৩শ’ ফুট চওড়া ছিল নদীটি। কিন্তু ১৯৭৬ সালে ২৯শ’ ফুট আবার বর্তমানে কমে ২৬শ’ ফুটে এসেছে। এরই প্রেক্ষিতে অতীত সব ভূমি সংক্রান্ত দলিলাদির ভিত্তিতে কর্ণফুলী নদীর তীর চিহ্নিত করা, প্রয়োজনীয় গাইডওয়াল নির্মাণ জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। নদীর তীরভূমি নির্ধারিত হলেই ভূমির বৈধ কিংবা অবৈধ দখল, ভরাট সমস্যা সহজে নিরসন করা সম্ভব হবে।