এ পাতার অন্যান্য সংবাদ
ভারতে শুধু গলাবাজি, কসোভোয় কাঁদানে গ্যাস শুরুতেই বিতর্কে জড়ালো সৌদি নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবাদ বিরোধী জোট এজিয়ান সাগরে শরণার্থী বোঝাই নৌকাডুবিতে নিহত ৫ সন্ত্রাসবিরোধী জোটে পাকিস্তান! চোরাচালানের দায়ে নাইজেরিয়ায় বাংলাদেশি দণ্ডিত মালালা নিন্দা জানালেন ট্রাম্পের বক্তব্যের। যুক্তরাষ্ট্রের ৩শ ফ্লাইট বাতিল সৌদির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর গিয়ে দারালো ১৫১ প্লুটোর নতুন ছবি প্রকাশ করল নাসা শ্রমিকের দক্ষতা বাড়াতে বিজিএমইএ-আইএলও চুক্তিইরানের রেইহানা’র মৃত্যুদণ্ড এবং প্রকৃত সত্য
| ১৬ কার্তিক ১৪২১ | Friday, October 31, 2014আজ ক’দিন ইরানের রেইহানা জাব্বারি (rayhaneh jabbari ) নামে এক মহিলার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে সারা বিশ্বে ব্যাপক অপপ্রচার চলছে; এর বাইরে নেই বাংলাদেশও। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ঝড় উঠেছে ওই নারীর পক্ষে তবে নিতান্তই অসত্যের পক্ষে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য লেখাটি লিখলাম। যারা সত্য অনুসন্ধান করতে চান তারা সত্যের সন্ধান পাবেন আর যারা সত্য অনুসন্ধান করতে চান না তাদের জন্য নিশ্চয় কুতর্কের খোরাক হবে।
প্রথমেই বলে নিই- বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা হলো বিদেশি খবর যাচাই বাছাই করার সুযোগ নেই। সে কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যম বিশেষ করে এএফপি, রয়টার্স, এপি, ভোয়া বা বিবিসি যা দেয় তাই চোখ বন্ধ করে গিলতে হয়। আর মিডিয়ার শীর্ষ পর্যায়ে যারা বসে আছেন তারাও এগুলো নিয়ে এত মাতা ঘামান না অথবা মাথা ঘামালেও ওই পশ্চিমাদের পক্ষ নেবেন। আর নারী বা কথিত মানবাধিকার ইস্যু হলে তো কথাই নেই। অবশ্য এর কারণও অনেক…ভিসা থেকে শুরু করে নানা সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করেন তারা। এছাড়া, ইসলাম বা ইরান বিদ্বেষী লোকের অভাব নেই। এ ধরনের খবর পেলেই তারা বলেন, বিবিসি বা ভোয়া বা অমুক বার্তা সংস্থা দিয়েছে তো! মনে হয় যেন এসব সংবাদ মাধ্যম কখনো খবর বা সত্য বিকৃত করে না! অথচ একজন মিডিয়াকর্মী হিসেবে খুব কাছ থেকেই জানি তাদের বিকৃতির ধরণ।
পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে রেইহানাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আরো বলা হচ্ছে ধর্ষণ থেকে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে মহিলাটি ওই লোকটিকে খুন করেছেন। অর্থাৎ নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে, ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুনের ঘটনাটি ঘটেছে। তারপরও তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে! তার মানে হচ্ছে নারীর এই প্রতিরোধকে স্বীকার করা হলো না, নারীর অধিকারকে স্বীকার করা হলো না। কেউ কেউ বলছেন, এই বিচারের মাধ্যমে ধর্ষণকে উৎসাহ দেয়া হলো।
অথচ প্রকৃত সত্য হলো রেইহানা ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুন করেন নি। ঘটনাটি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ইরানের বিচার বিভাগ এতটা নারী বিদ্বেষী নয় যে, অন্যায়ভাবে একজন নারীকে ফাঁসি দেবে। হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল। ওই মহিলা তার দোষও স্বীকার করেছেন আদালতে। রেইহানা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণেও ব্যর্থ হয়েছেন।
ঘটানাটি হচ্ছে দু’জনের অবৈধ সম্পর্কের জের ধরে এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় এবং এই খুনের ঘটনা ঘটে। সে ক্ষেত্রে পুরুষ লোকটি যে ভালো মানুষ ছিলেন তা বলা সুযোগ নেই। টানাপড়েনের একটি পর্যায়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যার কারণে রেইহানা লোকটিকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। খুনের দুই দিন আগে রেইহানা নতুন ছুরি কিনেছিলেন এবং তার এক বান্ধবীকে এসএমএস করেছিলেন যে, খুনের ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে। এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার তাহলো- এই মহিলার সঙ্গে ইরানের আদালতের এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি যে তাকে ফাঁসি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়ে দেবে। অথবা এই মহিলা ইরানের জন্য কোনো হুমকি ছিলেন সে কারণে তার ফাঁসি কার্যকর করা হলো। বরং যদি এমন হতো যে, খুন হয় নি বরং অবৈধ সম্পর্ক বা ধর্ষণের ঘটনার বিচার হচ্ছে তাহলো ওই পুরুষ লোকটাও মৃত্যুদণ্ডের মুখে পড়তো। এবং এ ক্ষেত্রেও ইরানের আইন অনুসরণ করা হতো…দেখা হতো না কে পুরুষ আর কে নারী; যেমনটি দেখা হয় নি রেইহানার ক্ষেত্রে।
৭ বছর আগের ঘটনা এটি; এমনটি নয় যে, তাড়াহুড়ো করে একজন নারীকে ফাঁসি দিয়ে আদালত একটা বিরাট কিছু করে ফেলছে। বাস্তবতা হচ্ছে- এটা নিতান্তই মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা গণমাধ্যম ও কথিত মানবাধিকার কর্মীদের প্রচারণা। আমি তো ইরানে থাকি, এখানকার নারীরা যে কতটা স্বাধীনতা ভোগ করেন তা বেশ কাছ থেকে দেখার সুযোগ হচ্ছে।…এবং ইরানের সমাজে নারীর যে কত মূল্যায়ন তা অনেকের জানা নেই এবং জানলেও তা প্রকাশ করবেন না বরং বলার চেষ্টা করবেন ইসলামি সরকার এতটা বর্বর এবং এ কারণে একজন নারীকে ফাঁসি দিল ইত্যাদি ইত্যাদি। কল্পনা করা যাক- যদি ঘটনাটা পুরুষের বেলায় ঘটত তাহলে কি পুরুষ লোকটা বেঁচে যেতেন ফাঁসির হাত থেকে। নিশ্চয় নয়। ইরানের আইনের মুল ভিত্তি হচ্ছে ইসলামি বিধান। যে অন্যায় ঘটেছে তার জন্য নারী পুরুষ মুখ্য বিষয় নয়; মুখ্য বিষয় হচ্ছে আইন এবং তার বাস্তবপ্রয়োগ। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর বহু খুনের ঘটনার বিচার হয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে দোষীদেরকে; সেখানে নারী-পুরুষ কখনো বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে নি; বিচার হয়েছে অপরাধের।
২০০৭ সালে সংঘটিত হয় আলোচ্য হত্যাকণ্ডটি। ঘটনাটি সাত বছর ধরে পুঙ্খানুপঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে তারপর ইরানের আদালত রায় দিয়েছে। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে পরে আবার বিচার হয়েছে এবং রায় বহাল রাখে। তারপরও এক মাস দেরি করা হয়েছে যে ভিক্টিম পরিবার যদি মাফ করে দেয় তাহলে ফাঁসিটি কার্যকর করা হবে না। কিন্তু ওই পরিবার মাফ করে নি। ইরানের বিচার ব্যবস্থায় খুনের ঘটনায় কারো মৃত্যুদণ্ড হলে ভিক্টিম পরিবার ছাড়া কারো পক্ষে সে রায় উল্টানোর সুযোগ নেই এমনকি প্রেসিডেন্ট বা সর্বোচ্চ নেতাও পারেন না। এটা ইসলামের বিধান…তা কারো ভালো লাগুক আর না লাগুক। মনে রাখতে হবে ইরান সম্পূর্ণ স্বাধীন-সার্বভৌম ইসলামি বিপ্লবের দেশ। ইসলামি আইন হচ্ছে এখানকার বিচার ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। কারো কথায় তার বিচারবিভাগ প্রভাবিত হবে না; কারো কথায় আদালতের রায় পাল্টায়ও না। কারো কথায় ইরান চলবেও না। এ ধরনের একটি বিচার কেন শতটি বিচারের ক্ষেত্রে আমেরিকাকে পাত্তা দেবে না ইরান। আমেরিকাকে পাত্তা দেয় না বলেই তারা বিষয়গুলো নিয়ে বেশি পানি ঘোলা করে। মানাবধিকারকে বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু আমেরিকার মানবাধিকার পরিস্থিত কি?? এই যে গতকালও একটা নিউজ বের হয়েছে, ২০১২ সালে আমেরিকায় ৪৯ বছর বয়সী মিল্টন হল নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে আট পুলিশ ঘিরে ধরে ৪৫টি গুলি করে হত্যা করেছে, যেন ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে! গতকাল তার ভিডিও ফুটেজ বের হয়েছে। যে দেশের প্রেসিডেন্ট নিজে কৃষ্ণাঙ্গ সেই দেশের অবস্থা যিদ এই হয় তাহলে অন্য সময় কি হয় আর বাস্তব অবস্থা কতটা নির্মম!! আচ্ছা, গুয়ান্তনামো কারাগারের কথা কেন তুলে ধরি না। সেখানে বছরের পর বছর বিনা বিচারে শত শত মুসলমানকে আটকে রাখা হয়েছে সন্ত্রাসবাদের অজুহাতে। তারা অনশন করেন বলে নাকের ভেতর দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে। কিন্তু এসব নিয়ে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মিডিয়া খবর দেয় না। দেবে কোথা থেকে? এগুলো তো আর পশ্চিমা মিডিয়া সচরাচর প্রচার করে না!
যাই হোক, নারীবাদী অ্যাঙ্গেল থেকে জাব্বারির মৃত্যুদণ্ডের ঘটনাটি দেখলে সত্য এড়িয়ে যাওয়া হবে। ইরানে নারীবাদ বা পুরুষবাদ বলে কিছু নেই। পরিশেষে বলব, সবারই তো বিশেষ করে সংবাদকর্মীদের জানা থাকার কথা যে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো কেমন করে খবর বিকৃত করে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করে!!! আর মানবাধিকার যেন তাদের বাপ দাদার সম্পত্তি; এটি তারা ছাড়া রক্ষা করার আর কেউ নেই! ইরাক-আফগানিস্তানে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে এরা কিন্তু ভাবখানা এমন যে, তা কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় পড়ে না..ইরানে এক নারীকে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সেটা বিরাট বড় ঘটনা! মানবাধিকার ইস্যুকে তারা যুগ যুগ ধরে এভাবেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে; কারণ এ না করলে যে তাদের সব অন্যায় ধরা পড়ে যাবে, বুঝে ফেলবে বিশ্ববাসী! আমরা তাদের এমন প্রতারণার শিকার বৈকি!
লেখক : সিরাজুল ইসলাম (ইরান প্রবাসী বাংলাদেশী সাংবাদিক)